রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যদি কিছু বলতেই হয়, তাহলে বলব-
"তোমার মতন এমন টানে কেউ তো টানে না।"
কখনও বসন্তের বাতাসের মতন ছুঁয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথ, আবার কখনও বর্ষার দিনে মন
কে মেঘের সঙ্গী হতে শিখিয়েছে আবার সেই রবীন্দ্রনাথ। পলাশের নেশায়ে বা সিক্ত জুঁই-কামিনীর
গন্ধে, কারণের অকারণের সুখে দুঃখে বাঙালির হৃদয়ে মিশে থাকে এই একটি নাম। রবীন্দ্রনাথ
শুধু একটি নাম নয়, একটি জীবনদর্শন। ওনাকে আমরা যত চিনেছি, তত বেশী চিনেছি জীবনকে। যত
বুঝেছি ওনাকে, তত বুঝেছি নিজেকে। প্রতিদিন নতুন করে জীবনকে অনুভব করতে শিখিয়েছেন,
অনুধাবন করতে শিখিয়েছেন। নিজেকে চেনার এক খোলা বইয়ের নাম হল রবীন্দ্রনাথ। সত্যিই
তাই “ তোমার মতো এমন টানে কেউ
তো টানে না “।
আজ বাইশে শ্রাবণ। বাঙালির চেতনা জাগানিয়া কবির ৭৭তম প্রয়াণবার্ষিকী। ১৯৪১
সালে এমনই এক বৃষ্টির দিন কে বেছে নিয় ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর। কবি নজরুল ইসলামের কথায়ে বলতে গেলে-
“দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্তপারের
কোলে,
বাংলার কবি শ্যামবাংলার হৃদয়ের ছবি
তুমি চলে যাবে বলে,
শ্রাবণের মেঘ ছুটে এলো দলে
দলে............
বাংলা ও বাঙ্গালীর অনুভুতির নিত্য
অনুসঙ্গ,কবিদের ইন্দ্র তুমি, তুমি রবীন্দ্র,
বাইশে শ্রাবণ তোমার প্রয়ান মৃত্যু নয়,
কেবলি দেহান্তর মাত্র ।“
মৃত্যু কিন্তু ছুঁতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ কে। রবি ঠাকুর আজ ও জীবিত কোটি কোটি
মানুষের হৃদয়ে। যার কলমের ছোঁওয়ায়ে মৃত্যু ও পেয়েছে সুর, পেয়েছে কাব্যরস, তাঁকে কি
মৃত্যু এত সহজে ছুঁতে পারে? মানুষকে যিনি জীবনমুখী করে রাখেন, তাঁর কি কখনও মৃত্যু
ঘটে? সেই রবি কি কখনও অস্ত যায়? বরং শ্রাবণের এই দিনে আমরা যেন আরেকবার বলে উঠি-
“শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে
তোমারি সুরটি আমার মুখের 'পরে, বুকের 'পরে ॥
পুরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দুই নয়ানে--
নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে পড়ুক প্রাণে।
নিশিদিন এই জীবনের সুখের 'পরে দুখের 'পরে।"
এমন ভাবে যুগযুগ ধরে মানুষের শিরায় শিরায় প্রবেশ করতে খুব কম কবিই পেরেছেন।
আমাদের আনন্দে, বিষাদে তিনিই থেকেচেন চিরসখা হয়ে। আমাদের চিত্ত যখন চঞ্চল,
জীবন যখন ঢেকে গেছে অন্ধকারে, তখন মন সব ভুলে ডুব দিয়েছে রবীন্দ্রনাথে।
তিনিই ডুবিয়েছেন, আবার তিনিই ভাসিয়ে তুলেছেন। তিনি যেন সেই মুক্তিদাতা যিনি না
বলতেই বুঝে গেছেন আমাদের সব কষ্ট, সমস্ত না পাওয়া, এনে দিয়েছেন মুক্তির স্বাদ,
খুলে দিয়েছেন দখিন-দুয়ার। নীরব কান্না কন্ঠ পেয়েছে গীতবিতানে। "আমার
নিখিল তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল।"
যা কিছু প্রাণহীন তা সুর খুঁজে পায়ে রবিগানে। শুধু তিনিই বোধহয় মৃত্যু তেও ঘটাতে
পারেন এক নতুন হৃদয়স্পন্দন।
"যা-কিছু জীর্ণ আমার, দীর্ণ আমার, জীবনহারা,
তাহারি স্তরে স্তরে পড়ুক ঝরে সুরের ধারা।"
অবসাদে ডুবে যাওয়া মানুষকে শিখিয়েছেন জীবনের মূলমন্ত্র। দুঃখ ও মৃত্যু কে জয়
করে বেঁচে থাকার চাবিকাঠি রবীন্দ্রনাথ। জীবন ও মরণের সীমানা ছাড়িয়ে তিনি
আজীবন আমাদের পরম বন্ধু। তাঁর মতন বন্ধু বোধহয় আর কেউ নেই।
তাই-
“তোমার অসীমে প্রানমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই -
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা
বিচ্ছেদ নাই।“
অমরত্বের প্রত্যাশা না করেও গভীর জীবনতৃষ্ণায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন –
‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই। এই সূর্যকরে
এই পুষ্পিত কাননে/জীবন হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।’
কিন্তু অমরত্ব ছাড়া আর কিই বা আমরা দিতে পারি তাঁকে? তাই তিনি আছেন। আজ ও চিরকাল
থাকবেন নয়নের মাঝখানে।
"নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।
বাসনার বশে মন অবিরত ধায় দশ দিশে পাগলের মতো
স্থির-আঁখি তুমি মরমে সতত জাগিছ শয়নে স্বপনে।
সবাই ছেড়েছে, নাই যার কেহ, তুমি আছ তার আছে তব স্নেহ
নিরাশ্রয় জন, পথ যার গেহ, সেও আছে তব ভবনে।
তুমি ছাড়া কেহ সাথি নাই আর, সমুখে অনন্ত জীবনবিস্তার-
কালপারাবার করিতেছ পার কেহ নাহি জানে কেমনে।
জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি, তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি
যত পাই তোমায় আরো তত যাচি, যত জানি তত জানিনে।
জানি আমি তোমায় পাব নিরন্তর লোকলোকান্তরে যুগযুগান্তর
তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই, কোনো বাধা নাই ভুবনে।"